🌺।।শ্রীশ্রী বিকটকালী মাতা।।🌺

দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি থানার অন্তর্গত ত্রিমোহিনীতে অবস্থিত শ্রী শ্রী বিকট কালিমাতার মন্দির। দেবী এখানে বিকটেশ্বরী বা দাপট কালী নামেও পরিচিত।

দূর থেকে দেখলে চোখে পড়বে দুটি দেব মন্দির। ভিতরে শিব মন্দির সহ বাইরে আরও  আটটি ছোট-বড় মন্দির।
রঙের প্রলেপ দেখে মনে হতে পারে হাল আমলে তৈরি। তবে ত্রিমোহিনীর দাপটকালী মায়ের মন্দির চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুরোনো ইট, মা চামুণ্ডার মুখোশ অন্য এক ইতিহাসের দিকে নিয়ে যায়।
মন্দিরের পাশেই রয়েছে সুবিশাল দিঘি।
ইতিহাসবিদদের মতে, পাল বা সেন আমল থেকেই পূজিতা হয়ে আসছেন দাপটকালী বা বিকট কালী মা। মা এখানে লৌকিক দেবী। চামুণ্ডা রূপেও পুজিতা হন।

মায়ের মুর্তিটি নির্মিত মুখোশ আকার। সারাবছর গর্ভ গৃহে মায়ের পূজা হয়ে থাকে। বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয় চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিনে। কিন্তু পূজার সূচনা হয়ে যায় নয় দিন আগে থেকেই। ৫ দিন আগে ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয় মায়ের গর্ভ গৃহে। লক্ষাধিক মানুষের ভিড় হয়। প্রায় ৫০০০ ভক্ত ব্রতী হন। বসে তিন দিনের মেলা।

রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা সহ রাজ্যের বাইরে থেকেও আসেন বহু পূণ্যার্থী। অনেক মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও এই পূজায় অংশগ্রহণ করেন। উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে জানা যায়, বিকটকালী বা চামুণ্ডা মায়ের পুজোর বিশেষ নিয়ম রয়েছে। পুজোর দিন নতুন বাঁশের ডালা মাথায় করে ভোগ দেওয়া হয়। দশ হাজারেরও বেশি মানুষ ডালায় করে ভোগ নিয়ে উপস্থিত
হন। পুজোর দিন মহিলারা চুলের মধ্যে গোবরজল, আলতা, সিঁদুর মাখিয়ে দেবীগৃহে অর্পণ করেন। মায়ের কাছে মনস্কামনা পূরণে পুণ্যার্থীরা মাথার চুল, পায়রা, পাঁঠা প্রভৃতি মানত করেন। পৈতা পরিধান, শ্মশান খেলা, নাগরা ভাঙা ইত্যাদি রীতির মধ্যে দিয়ে মূল
পুজো হয়। বিকটকালী মাতার মুখোশ নিয়ে নৃত্য এই উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ।

মন্দির ঘিরে শোনা যায় নানা অলৌকিক কাহিনী। সে বহুদিন আগের ঘটনা। গ্রামের কোনো বাড়িতে অনুষ্ঠান থাকলে মন্দিরের দিঘিতে এসে জানিয়ে গেলে পরের দিন নাকি বাসন মজুদ থাকতো দিঘির ঘাটে। ব্যবহারকার্য শেষ হলে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যেতে হতো সেই বাসন যথাস্থানে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মেখে আজও দাঁড়িয়ে আছে হিলির বিকটকালীর মাঠ। এই মাঠেই অস্থায়ী ক্যাম্প গড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছেন ভারতীয় জওয়ানরা।  ৪৯ বছর পরও মাঠের মাঝে কান পাতলে শোনা যায় মুক্তিযুদ্ধের অম্লান গল্প। যুদ্ধের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাতারে কাতারে সেনাবাহিনী পৌঁছে গিয়েছিল হিলিতে। যুদ্ধের রণকৌশল ঠিক করা হতো এই হিলি ত্রিমোহিনীর বিকটকালী মাঠের সেনা ক্যাম্প থেকেই। শোনা যায়, বিকট কালী মন্দিরের তেঁতুল গাছে তখন বিষধর সাপের ছোবলে পরে এক সেনা জওয়ান। তারপর থেকে সেনারা বিকটকালী মন্দিরের রোজ পুজো দিতেন। যুদ্ধে জয় লাভের মানতও করেছিলেন সেনারা। মুক্তিযুদ্ধে ৪০০- এর বেশি সেনা শহীদ হন। শহীদ সেনাদের স্মৃতিতে প্রতিবছর ১২ ডিসেম্বর শহীদ দিবস পালিত হয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভের পরবর্তী সময়ে পুজো দিয়ে একটি টিনের মন্দির তৈরি করে দিয়ে যান সেনা আধিকারিকরা। স্থানীয় প্রবীন বাসিন্দাদের মুখে আজও শোনা যায় ইতিহাসের সেসব স্মৃতি মধুর কাহিনী।